October 22, 2024, 7:33 am

১৫ই আগস্ট যেকারণে বরিশালবাসীর কাছে আরো বেশী শোক ও বেদনার

১৫ই আগস্ট যেকারণে বরিশালবাসীর কাছে আরো বেশী শোক ও বেদনার

বেলায়েত বাবলু, অতিথি লেখক ॥ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সেই কালো রাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিলেন। তাদের পাশাপাশি রাজধানীর মিন্টো রোডের বাসভবনে কৃষককূলের নয়নমনি মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতসহ বরিশালের বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছিলেন। তাই বরিশালবাসীর কাছে ১৫ই আগস্ট আরো বেশী শোক ও বেদনার। ওই দিনের কালো রাত্রিতে যারা নিহত ও আহত হয়েছিলেন তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হলো-

আবদুর রব সেরনিয়াবাত ঃ আবদুর রব সেরনিয়াবাত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেজ বোনের স্বামী। তার জন্ম: বাংলা ১৩২৭ বঙ্গাব্দের ১৪ই চৈত্র, বরিশালে। তিনি বরিশাল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে বঙ্গবন্ধুর সহপাঠী ছিলেন। বেকার হোস্টেলেও এক সঙ্গে থাকতেন। বঙ্গবন্ধুর সেজ বোন আমেনা বেগমের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। কলকাতায় আই.এ এবং বি.এ পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি পাস করে বরিশালে আইনজীবী ও রাজনৈতিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে প্রার্থী হয়ে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১- এর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ১৯৭২ সালের ১২ই এপ্রিল কৃষিমন্ত্রী হন। ১৯৭৩ এর নির্বাচনেও জয়লাভ করেন এবং বঙ্গবন্ধু তাকে সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী নিয়োগ করেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের কৃষিক্ষেত্রে সংস্কার ও উৎপাদনে এবং কৃষকদের সহায়তা দেওয়ায় তার ভূমিকা ছিল যথেষ্ট জোরালো। একজন সৎ আদর্শবান ব্যক্তি হিসেবে তিনি সব মহলে প্রশংসিত ছিলেন। তিনি বরিশালে আইন পেশার পাশাপাশি সাংবাদিকতায়ও জড়িত ছিলেন। বরিশাল প্রেসক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। তাই তাঁর স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে বরিশাল প্রেসক্লাবের নামকরন করা হয় শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত বরিশাল প্রেসক্লাব নামে। এছাড়াও বরিশাল আদালত পাড়ায় শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত আইনজীবী ভবন, সেতু এবং বরিশাল আইন মহাবিদ্যালয়সহসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামকরন করা হয়েছে।

বেগম আরজু মনি ঃ আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মনির স্ত্রী বেগম আরজু মনি। তার জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ মার্চ বরিশালে। তিনি বরিশাল সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং বিএম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও বি.এ. পাস করেন। আবদুর রব সেরনিয়াবাতের জ্যেষ্ঠ কন্যা ছিলেন তিনি। ১৯৭০ সালে খালাত ভাই শেখ ফজলুল হক মনির সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ১৯৭৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম.এ পরীক্ষা দিয়েছিলেন। দু’সন্তানের মা আরজুকে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় স্বামীর সঙ্গে গুলি করে হত্যা করে ঘাতকরা। বর্তমানে তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত বরিশালে শহীদ আরজু মনি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে।

বেবী সেরনিয়াবাত ঃ আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ছোট মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত ১৯৬০ সালের ২ মে বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরী হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী ছিল বেবী। নিহত হবার সময় পিতার কাছে ছিলেন তিনি। আরিফ সেরনিয়াবাত ঃ আবদুর রব সেরনিয়াবাতের কনিষ্ঠ পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাতের জন্ম ১৯৬৪ সালের ২৭ মার্চ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরী উচ্চ বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র আরিফ নিহত হওয়ার সময় ঢাকায় তার পিতার কাছে ছিল।

সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু ঃ আবদুর রব সেরনিয়াবাতের নাতি সুকান্ত আবদুল্লাহ’র জন্ম ১৯৭১ সালের ২২ জুন বরিশালের গৌরনদীতে। আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ছেলে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রিয় কার্য নির্বাহী কমিটির সদস্য ও বরিশাল জেলা সভাপতি, সাবেক চিফ হুইপ আবুল হাসনাত আবদুল্লাহর জ্যেষ্ঠ পুত্র সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু নিহত হওয়ার সময় বয়স ছিল মাত্র ৪ বছর এবং সে সময় ঢাকায় দাদার বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলেন তিনি।

শহীদ সেরনিয়াবাত ঃ আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাতের জন্ম ১৯৪০ সালের ২৬ মার্চ বরিশালে। বরিশালের ঐতিহ্যবাহী বি এম স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, বিএম কলেজ থেকে আই. এ. ও বি. এ. পাস করেন তিনি। ঢাকা থেকে আইন পাস করে বরিশালে কোর্টে আইনজীবী পেশায় নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি। পাশাপাশি তিনি দৈনিক বাংলা পত্রিকার বরিশালের সংবাদদাতা ছিলেন। বরিশাল প্রেসক্লাবের সদস্য ছিলেন তিনি। ১৫ আগস্ট চাচার বাসায় অবস্থানকালে নিহত হন শহীদ সেরনিয়াবাত।

আবদুল নঈম খান রিন্টু ঃ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য ও শিল্পমন্ত্রী আমীর হোসেন আমুর খালাতো ভাই আবদুল নঈম খান রিন্টু ১৯৫৭ সালের ১ ডিসেম্বর বরিশালে জন্মগ্রহন করেন। বরিশাল জেলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেন। বরিশালের সাড়া জাগানো ব্যান্ড দল ক্রিডেন্স সাংস্কৃতিক দলের সঙ্গে ঢাকায় গিয়েছিলেন এবং তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় অবস্থানকালে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের নির্মম বুলেটে নিহত হন।

সৈয়দ গোলাম মাহমুদ ঃ নগরীর সদর রোডে ১৯৫৯ সালে জন্মগ্রহন করা সৈয়দ গোলাম মাহমুদ ছিলেন বরিশালের ক্রিডেন্স ব্যান্ড দলের সদস্য। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বরিশালের কৃতি সন্তান, কৃষক কুলের নয়নের মনি মন্ত্রী শহিদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ঢাকার মিন্টু রোডের সরকারি বাসভবনে মাহমুদ সৈয়দ গোলাম মাহমুদ গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন এবং পরবর্তীতে ওই বছরের ৩ নভেম্বর ইন্তেকাল করেন। মাহমুদের ভাই বরিশাল জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট সৈয়দ গোলাম মাসউদ বাবলু তাঁর ভাইয়ের মুখে ১৫ আগস্টের সেই রাতের ভয়াবহ বর্ননা শুনে পরবর্তীতে শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত হত্যা মামলার স্বাক্ষী হয়ে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন।

৭৫-এর ১৫ আগস্ট মিন্টো রোডের বাসভবনে অবস্থানকালে ভাগ্যের জোড়ে বেঁচে গিয়েছিলেন আবদুর রব সেরনিয়াবাতের জ্যেষ্ঠ পুত্র বর্তমানে পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন ও নিরীক্ষন কমিটির আহবায়ক (মন্ত্রী) আওয়ামী লীগের কেন্দ্রিয় কার্য নির্বাহী কমিটির সদস্য ও বরিশাল জেলার সভাপতি, সাবেক চিফ হুইপ আলহাজ্ব আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ। তবে ঘাতকের বুলেট যেমন তার পিতা, দুই বোন, ভাই, পুত্রকে কেড়ে নিয়েছে তেমনি বুলেটের আঘাতে গুরুতর আহত হয়ে সেই দিনের ভয়াবহ স্মৃতি দীর্ঘ ৪৫ বছর বয়ে বেড়িয়েছেন তাঁরই সহ-ধর্মিনী বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান কার্যকরী কমিটির সিনিয়র সহÑসভাপতি সাহান আরা বেগম।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের প্রত্যক্ষকারী শহীদ জননী সাহান আরা বেগম ২০২০ সালের ৭ জুন ইন্তেকাল করেন। ঘাতকের বুলেটের মুখে মমতাময়ী মা সাহান আরা বেগম বুকের ভিতরে আগলে রাখায় বেঁচে গিয়েছিলেন সেদিনের ছোট্ট শিশু বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। সেদিন মিন্টো রোডের বাসভবনে উপস্থিত থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া বরিশালের ডা. খ.ম জিল্লুর রহমান, ললিত দাস সহ অনেকেই সেই রাতের দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন এখনো।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © All rights reserved © 2024 DailyBiplobiBangladesh.com
Desing & Developed BY ThemesBazar.Com